ব্রেকিং নিউজ

চিৎকার করে মঞ্চে কাঁদলেন জেমস, না পেরে নেমে গেলেন মঞ্চ থেকে!

বিনোদন ডেস্ক,জনগণের কণ্ঠ:মঞ্চে কাঁদলেন জেমস- বাংলাদেশের কিংবদন্তী একজন শিল্পী তিনি। একাধারে তিনি গায়ক, গীতিকার, সুরকার, এবং উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ গিটারিস্ট। তিনি আমাদের আইয়ুব বাচ্চু।

কিন্তু দুঃখজনক ভাবে তিনি আর আমাদেরএ মাঝে নেই। কিন্তু আজকের এই দিনেও তার কাছের একজন সহশিল্পী বাংলাদেশের আরেকজন কিংবদন্তী জেমস তার পাশে থাকতে পারেন নি এই সময়।

আর তাই মঞ্চে উঠে চিৎকার করে কাঁদলেন তিনি। দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে অঝোরে। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু শোক তাকে আঁকড়ে ধরে ছিল। সহ্য করা কঠিন। জেমসের এই চেহারা কোনোদিন কেউ দেখেনি! স্টেজ ভেঙে পড়া কান্না!

বরগুনার এই কনসার্টটি সরাসরি প্রচারিত হয়েছে ‘দেশ টিভি’ তে। জেমস শুরুতেই শো টি আইয়ুব বাচ্চুকে ডেডিকেট করে, হু-হু করে কাদতে কাদতে ২-১ মিনিট গিটার বাজিয়ে, একটা গানের ২-৩ লাইন গেয়ে, আচমকা থেমে গিয়ে, ‘বন্ধুরা, আমাকে একটু ৫-১০ মিনিট সময় দাও, আমি আসছি…’ বলে নেমে গেছেন মঞ্চ থেকে।

মা বলতেন, আমার দুই ছেলে
চট্টগ্রামের জুবলি রোডে আমরা পাশাপাশি থাকতাম। আমি তখন ক্লাস এইট-নাইনে পড়ি। আমার চেয়ে বয়সে একটু বড়ই হবে বাচ্চু। ১৯৭৭ সালে প্রথম ব্যান্ড ‘রিদম ৭৭’ করি। চট্টগ্রামের হেন জায়গা নেই, যেখানে আমরা বাজাইনি।
দুই বছর পর করলাম ‘ফিলিংস’। বাচ্চুও যোগ দেয়। আমরা তখন ইংরেজি ইনস্ট্রুমেন্টালই বেশি করতাম। ‘ফিলিংস’ প্রথম কাজ পায় আগ্রাবাদ হোটেলে।

ওখানে বিদেশি অতিথিরাই বেশি থাকত। দীর্ঘদিন এই হোটেলে বাজিয়েছি। সেই সময় থেকেই আসলে বাচ্চু ওয়েস্টার্ন ঘরানার গিটার বাজানো শুরু করে। রাত করে ঘরে ফিরতাম। মা রান্না করে আমাদের খাওয়াতেন।

মা বলতেন, আমার দুই ছেলে। মাকে এখনো বাচ্চুর মৃত্যুর খবরটা জানাইনি। মাঝেমধ্যে প্রায়ই ফোন করে ও বলত—দোস্ত, মাসিমাকে দেখতে আসব। আমাদের সম্পর্ক এমন ছিল যে আমরা পরস্পরকে ‘মামা’ বলে ডাকতাম।

আমি ঢাকায় চলে এলে ও তখন ‘সোলসচিৎকার করে মঞ্চে কাঁদলেন জেমস, না পেরে নেমে গেলেন মঞ্চ থেকে!-এ গিটারবাদক হিসেবে যোগ দেয়। এরপর বাচ্চু ঢাকায় চলে এলো। আমরা তখন একসঙ্গে থাকতাম। এমনকি এক খাটেও ঘুমিয়েছি। এভাবেই তিন-চার বছর কাটিয়েছি। সম্ভবত ১৯৮৫ সালে আমরা একসঙ্গে শেষবার বাজিয়েছিলাম। সেটা ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠান।

এরপর বাচ্চু একদিন বলল—দোস্ত, একটা ব্যান্ড করতে চাই। একটা বাসা নিয়ে দে না। আমার বাসার পাশেই একটা বাসা নিয়ে দিলাম। সেটা এতটাই কাছে ছিল যে জানালা দিয়েই কথা বলা যেত। এরপর বাচ্চুর প্রেম, বিয়ে। বিয়ের বাজার সদাই, বরের গার্জিয়ান হিসেবে যাওয়া—সব কিছুই করেছি আমি।

৪০ বছর ধরে সংগীতাঙ্গনে একসঙ্গে কাজ করলে কত স্মৃতিই না জমা হয়! সংগীতশিল্পী হিসেবে সে এককথায় অসাধারণ। নিজেকে সব সময় আপগ্রেড করতে চাইত। কিছুদিন আগে একটা অনুষ্ঠানে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল।
তখন বাচ্চু বলেছিল—দোস্ত, শেষ পর্যন্ত হয়তো আমাদের একজন আরেকজনকেই কাঁধে নিতে হবে। তাই আমাদের সম্পর্কটা আরো নিবিড় হওয়া দরকার।’
বাবাকে নিয়ে স্বপ্নটা পূরণ হলো না বাচ্চুর
৩৪৪ জুবিলী রোড, নুরুজ্জামান সওদাগরের বাড়ি। চট্টগ্রাম নগরের এনায়েত বাজার এলাকার তিনতলার ভবনটির গায়ে শেওলা জমেছে। বিভিন্ন জায়গায় জন্মেছে পরগাছা। দীর্ঘদিন রং না করায় এখন বিবর্ণ। হঠাৎ করে আজ বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে ভবনটিতে দর্শনার্থীর আনাগোনা বেড়ে যায়।

একের পর এক আসতে থাকে সাংবাদিকের গাড়ি।
এই বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ফিরিঙ্গিবাজারের হাজী নুরুজ্জামান আবাসিক এলাকার ‘হাজী বিল্ডিং’ ও ‘সখিনা ম্যানশন’। সেখানেও একই চিত্র। চট্টগ্রাম নগরের তিন ভবনে এখন শোকের ছায়া। কারণ এই ভবনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জনপ্রিয় ব্যান্ডশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর বেড়ে ওঠার স্মৃতি। এসব ভবনের বাসিন্দারা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না তাঁদের প্রিয় ‘বাচ্চু’ আর নেই।

আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে শুধু গানের জগতে কিংবা গায়কের শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি। গিটারিস্টদের জগতে বিশাল একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ছিলেন এই উপমহাদেশের অন্যতম সেরা গিটারিস্টদের একজন।

বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলোকে এ কথা বলেন দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ নেওয়াজ। তাঁর হাত ধরেই সোলসে এসেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সময় তখন ১৯৮২ সাল।

সে দিনের কথা স্মৃতিচারণা করে আহমেদ নেওয়াজ বলেন, ১৯৭৩-৭৪ সালে সোলসের যাত্রা শুরু হয়। শুরুর দিকে ভালোই চলছিল। কিন্তু ১৯৮২ সালের দিকে সংকটে পড়ে সোলস।
এই সংকট ছিল গিটারিস্টের। ওই সময়ে শুনতে পান আইয়ুব বাচ্চুর কথা। নগরের দেওয়ানহাট এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় কথা হলে তাঁকে সোলসে যোগ দিতে বলা হয়। এরপর গিটারিস্ট হিসেবে সোলসে যোগ দেন তিনি।

বাচ্চু যোগ দেওয়ার পর সোলসের গানের ধরন পাল্টে যায় বলে মন্তব্য করেন আহমেদ নেওয়াজ। তিনি বলেন, ‘আমরা বিকেলে সবাই দুই-তিন ঘণ্টা প্র্যাকটিস (অনুশীলন) করতাম। কিন্তু বাচ্চু রাত দুই-তিনটা পর্যন্ত প্র্যাকটিস করতেন।’
সংগীতের প্রতি আইয়ুব বাচ্চুর সাধনা অন্য রকম ছিল মন্তব্য করেন ছোটবেলার বন্ধু চিটাগং মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী। বাচ্চু এশিয়া উপমহাদেশের সেরা ১০ গিটারিস্টের একজন উল্লেখ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ফুটবল-ক্রিকেট খেলতাম না।

আমাদের খেলা ছিল সংগীত নিয়ে। স্কুলের সময় ছাড়া রাত-দিন গান নিয়ে পড়ে থাকতাম। বাচ্চু তখন থেকেই দারুণ গিটার বাজাতেন। স্কুলে থাকার সময় বাচ্চু বিশ্বের বড় বড় শিল্পীদের ক্যাসেট জোগাড় করতেন, তা রপ্ত করতেন। পরে গিটারে তুলতেন।’

১৯৮২ সালে সোলসে যোগ দেওয়ার আগে লালখান বাজার এলাকায় জ্যাকব ডায়েসের প্রতিষ্ঠিত স্পাইডার ব্যান্ডে গিটারিস্ট হিসেবে ছিলেন বলে জানান সোলসের তৎকালীন ড্রামার সুব্রত বড়ুয়া রনি।

তিনি প্রথম আলোক বলেন, বাচ্চু সেরা গিটারিস্ট ছিল। সে শুধু গিটারই বাজাত না। গানও লিখত। নিজেই সুর দিত। বাচ্চু আসার পর সোলসের গানের স্টাইলই চেঞ্জ হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ছাড়িয়ে গেছে বাচ্চু।

ব্যান্ড জগতের কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন এই সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড দল তিরন্দাজের ভোকাল শান শাহেদ। হঠাৎ মৃত্যু এখনো মেনে নিতে পারছেন না এই তরুণ শিল্পী।

তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চু ভাই আমাদের বলতেন, তোমাদের নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন আছে। সংগীত নিয়ে তোমরা যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারো, সে জন্য কাজ করছি। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক, পরিবারের সদস্য। তাঁর মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণ হওয়া কঠিন।’

এক মাস আগে ঢাকায় আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে সরাসরি দেখা হয় ছোট বোন আফরিন মুন্নীর স্বামী ওমর উদ্দিন আনসারির। সপ্তাহখানেক আগে মুঠোফোনে শরীরের খোঁজখবর নেন তিনি।

কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে মুঠোফোনে যে খবরটি শোনেন, তার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলেন না ওমর উদ্দিন। ‘বাচ্চু ভাই আর নেই’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফিরিঙ্গিবাজারের সখিনা ম্যানশনে কান্নার রোল ওঠে। বোন মুন্নীর আহাজারিতে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না শোকাহত অন্য সদস্যরা।

বাসায় থাকলেও বড় ছেলের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হয়নি বাবা মোহাম্মদ ইছহাককে। বিকেলে ওমর উদ্দিন আনসারি বলেন, ‘সকালে সবাই মিলে নাশতা করতে বসছিলাম। ঠিক ওই সময় খবরটি পাই।

এ ধরনের খবর আসবে তা কল্পনা করিনি। এটি আমাদের জন্য অবিশ্বাস্য সংবাদ।’ তিনি জানান, চৈতন্যগলির কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে বাচ্চুকে কবর দেওয়া হবে।

আইয়ুব বাচ্চুর জীবনের একটি অংশ কেটেছিল নুরুজ্জামান আবাসিক এলাকার হাজী বিল্ডিংয়ের তিনতলায়। সেখানে ভাইবোনদের নিয়ে বসবাস করতেন বাবা। এখন সেখানে ভাড়াটে থাকেন।
এই ভবনের নিচতলায় থাকেন ফুফাতো ভাই হাসান রিয়াদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৩ অক্টোবর চট্টগ্রামের জিইসি কনভেনশনে প্রোগ্রাম ছিল ভাইয়ার (আইয়ুব বাচ্চুর)। অনুষ্ঠান শেষ করেই ফোন দেন।

অ্যাভিনিউ হোটেলে খেতে আসতে বলেন। ব্যস্ততার জন্য যেতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে কেন সেদিন গেলাম না। গেলে অন্তত ভাইয়ার সঙ্গে শেষ দেখা হতো। নিজের ওপর এখন রাগ হচ্ছে।
এনায়েত বাজারের বাড়িটিতেই জন্মেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। এখন আর পরিবারের কেউ থাকেন না এই ভবনে। বিভিন্ন কক্ষ ভাড়া দেওয়া হয়েছে। মেসও আছে সেখানে। আছে গুদামঘর ও দোকান।

এই ভবনের একটি কক্ষে ১৩ বছর ধরে ভাড়া থাকেন রাজা মিয়া। গিটারিস্ট বাচ্চুর চেয়ে গায়ক বাচ্চু তাঁর কাছে অধিক প্রিয়। তিনি বলেন, ‘একসময় যখনই আইয়ুব বাচ্চুর ক্যাসেট বের হতো, তা সংগ্রহ করতাম, আর শুনতাম।

তাঁকে আমরা বাড়ির মালিকের চেয়ে গায়ক হিসেবে বেশি চিনি। একসময় বছরে অন্তত একবার হলেও আসতেন। তবে ২০১২ সালের পর থেকে সেভাবে আসতেন না।’

প্রায় দুই মাস আগে এক দুপুরে চট্টগ্রাম এসে দেখা করেন সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে চলে বিভিন্ন খুনসুটি।

আলাপের একপর্যায়ে মেয়রকে জানান, চট্টগ্রাম নগরের পছন্দনীয় এলাকায় মনের মতো বাড়ি করার স্বপ্ন রয়েছে। বাবাকে এনে রাখবেন সে বাড়িতে। আর ঢাকা থেকে আসা-যাওয়া করবেন।

সংগীত জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর একেবারেই চট্টগ্রামে চলে আসবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। সে দিনের স্মৃতিচারণায় আক্ষেপ করে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘স্বপ্নটা পূরণ হওয়ার আগেই হুট করে চলে গেল বাচ্চু। এটি ভেবে খারাপ লাগছে।’

Leave a Reply